১।
পড়ন্ত দুপুর। পুকুরের পানিতে হিজল গাছের লম্বা ছায়া পড়ছে। একপাশে লম্বা একটা ডালে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে আছে বকুল। শাড়ির কোচড়ে কয়েকটা চ্যাপ্টা নুড়ি পাথর, নেড়েচেড়ে দেখছে সে। মানিকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে। আজকে ওকে ব্যাঙ শেখানোর কথা মানিকের। হাত ঘুরিয়ে কিভাবে যেন পাথর ছুড়ে মারে, আর সেটা পানিতে লাফাতে লাফাতে যায়। চমৎকার লাগে বকুলের।
বসে থাকতে খুবই বিরক্ত লাগছে তার। কোথায় খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দিবে, তা না করে ঘর থেকে বাবার চোখে ফাঁকি দিয়ে এই দুপুরবেলায় পুকুরপাড়ে বসে আছে কতক্ষণ ধরে। এমন সময় মণিকে দেখলো বকুল, মানিকের বড় বোন সে। তার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা ধরে।
-“দিদি!”, জোরে ডাক দিলো বকুল। মণি থমকে দাঁড়ালো। হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকলো বকুল, কিন্তু মণি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
-“মানিক আসেনা কেন? কই গেছে ও?”
-“মানিক আসবেনা। বাবা ওকে তোর সাথে ঘুরতে মানা করেছে। আমাকেও মানা করেছে তোর সাথে কথা বলতে।”
-“আমি কি করলাম?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো বকুল। অপমানে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। তার তের বছরের জীবনে এতবড় অপমান আগে কেউ করেনি।
-“তোর বাবা মিলিটারির সাথে উঠাবসা করে। তুই রাজাকারের মেয়ে, এইজন্য।”
-“আমি তো রাজাকার না, আমার সাথে কথা বলনা দিদি।” বকুলের কন্ঠে একরাশ আকুতি ঝরে পড়ে।
-“না, বাবা মারবে।” বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেল মণি।
লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে চোখে পানি চলে আসলো বকুলের। কান্নার তোড়ে একটু পর পর কেঁপে উঠছে সে। কোচড়ের নুড়িগুলো একটা একটা করে সব ছুড়ে মারলো পানিতে। পানিতে আলতো ঢেউ তুলে ডুবে গেলো সেগুলো। ওর নিজেরও ডুবে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। গেলো সপ্তাহে তাদের গ্রামে স্কুলঘরে আস্তানা গেড়েছে মিলিটারিরা। তার বাবা, সুরুজ মিঞা, মোসলেহউদ্দিন এবং আরও কয়েকজন মিলে পাকিস্থানের পতাকা উঁচিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাদের সাথে। তারপর থেকেই শুরু হলো গ্রামবাসীদের উপর মিলিটারিদের অত্যাচার। বাজার থেকে ইচ্ছামত সদাই তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু এক পয়সা দামও দেয়না। সেদিন জাহানারার পালা ছাগলটাকে ধরে নিয়ে গেল, তারপর থেকে বকুলের সাথে আর একটা কথাও বলেনি জাহানারা। তাদের কীর্তিতে সবাই কমবেশি অতিষ্ঠ, কিন্তু ভয়ে মুখে এতটুকু প্রতিবাদও করতে পারেনা।
কিছুক্ষণ পর চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো সে। পশ্চিম আকাশে লাল রঙ ধরে যাচ্ছে। বাবা ভাতঘুমে থাকতে থাকতেই ঘরে ফেরা দরকার, দেরি করলে বাবার সামনে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে তিন-চারদিন আর ঘর থেকেই বের হতে পারবেনা।
পা টিপে টিপে উঠান পার হয়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো বকুল। তাদের বাড়িটা গ্রাম থেকে একটু আলাদা। খুব কাছাকাছি তেমন একটা ঘরবাড়ি নেই। টিনের চালা, ঝকঝকে উঠান, গোছানো গোয়ালঘর- সবখানেই বিত্তের একটা সূক্ষ্ণ ছাপ।
-“দাঁড়া।” পেছন থেকে তাকে থামতে বললেন বকুলের বাবা মোসলেম আলি। চাপদাড়ি মুঠো করে ধরে রেখেছে সে।
বাবার গলা শুনেই জমে গেলো বকুল। অসম্ভব ভয় পায় সে ওই গলার মালিককে।
-“দুপুরে কই ছিলি?” ঠান্ডা এবং রূঢ় গলায় প্রশ্ন করলেন মোসলেম আলি। জবাব দিলনা বকুল। মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে উঠানের মাটি খুঁটতে লাগলো।
-“বয়সী একটা মেয়ে হয়ে তুই দিনে-রাতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস? এই বাড়ির মেয়ে হয়েও এত ঘুরাঘুরি করার শখ? সাহসতো কম না তোর হারামজাদি?”
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো বকুল। কান্না চাপার চেষ্টা করছে অনেক। কিন্তু পারছেনা।
-“তিন দিন তুই ঘর থেকে বের হবিনা।” হাতের মেসওয়াক করার নিমের ডাল উঁচিয়ে বকুলের ঘর দেখিয়ে দিলেন তিনি।
একছুটে নিজের ঘরে চলে আসলো বকুল। নিজের তেল চিটচিটে বালিশে মুখ লুকিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। কখন যে ঘুমে চোখ মুদে আসলো টেরই পেলনা সে।
২।
তেরপলের পর্দা সরিয়ে ছাউনিতে ঢুকল আনিস। ভিতরে টেবিলের উপর চল্লিশ ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে, টেবিলে একটা ম্যাপ ফেলে উবু হয়ে কি যেন দেখছে আসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আনিসের থেকে তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন তিনি। ইকবাল হল থেকে অপারেশন সার্চলাইটের সেই রাতে যে ক’জন পালাতে পেরেছিল তাদের মাঝে ছিল আনিস এবং আসলাম।
হাতের স্টেনগানটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে একটা নোংরা গামছা তুলে নিয়ে ঘামে ভেজা মুখটা মুছে নিল আনিস। ভ্যাপসা আর গুমোট একটা ভাব ছাউনির ভেতরে। একপাশে বসে বসেই ঝিমুচ্ছে রাশেদ, দলের বাকি কয়েকজন অঘোরে ঘুমাচ্ছে।
-“আসলাম ভাই।” মৃদুস্বরে ডাকলো আনিস।
মুখ তুলে তাকালো আসলাম। গত দু’রাত নির্ঘুম কেটেছে তার নতুন অপারেশনের ছক কাটতে গিয়ে। মুখে বেশ কয়েকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর কাঁধ ছেয়ে যাওয়া চুলে তাকে কেমন যীশুর মত লাগছে।
-“হুম, বলো?” হাতে লেগে থাকা কালি তার জলপাই রঙের শার্টে মুছে ফেললো সে। কন্ঠে স্পষ্ট ক্লান্তির সুর।
-“একটু ঘুমিয়ে নেন। অপারেশনের দিন ঘুমাতে পারবেন বলে মনে হয়না।”
-“এম্যুনিশন হাতে না আসা পর্যন্ত ঘুম আসবেনা আমার। ঘাটে কাউকে রেখে এসেছো?”
-“গৌতমদা আছেন।”
-“আকাশে মেঘ অনেক। ঝড় হবে মনে হচ্ছে।” দুশ্চিন্তার কালো মেঘে ঢেকে গেলো তার চেহারা। “এম্যুনিশন ভিজে গেলে তো হবে আরেক যন্ত্রণা। অপারেশনই পেছাতে হবে।”
-“অপারেশন কি একটু পেছানো যাবে আসলাম ভাই? সবার মনে হয় একটু বিশ্রাম দরকার ছিলো।” এককোণে শুয়ে থাকা সহযোদ্ধাদের ঘুমন্ত শ্রান্ত মুখের দিকে একবার চাইলো সে।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আসলাম।
-“কপিলমুনি এখন একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। তিরিশ তারিখ ওখানে নৌকায় করে গোলাবারুদ পৌঁছানো হবে, তারপর ওটা হয়ে যাবে একটা অস্ত্রাগার। আশেপাশের সব গ্রাম ছারখার করে দিবে পাকিস্তানীরা।” একটু দম নিলো সে।
-“কিন্তু এর সাথে অপারেশন পেছানোর কি সম্পর্ক?” ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো আনিস।
-“সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে আমরা এখনো কপিলমুনিতে গোলাবারুদ পৌঁছানোর আসল সময়টুকু বের করতে পারিনি। ওইখানে আমাদের ইনফর্মার আছে, একজন স্থানীয় লোক। যদি আমাদের অপারেশনের আগে তাদের কাছে এম্যুনিশন চলে যায়, তাহলে সে খবর পাঠিয়ে দেবে, আমরা অপারেশন পিছিয়ে অপেক্ষা করবো। শুধু শুধু হালকা কয়েকটা স্টেনগান আর কয়েকটা পাইনএপেল দিয়ে মেশিনগানের সাথে লাগতে যাওয়ার মানে নেই। আর কোন খবর না আসলে আমরা আগামী পরশু বিকেলেই হীরণ মাঝির নৌকা করে রওনা দিয়ে দিব। অপারেশন শুরু হবে সন্ধ্যাবেলা।” পাশে রাখা পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক ঢোকে খালি করে ফেললো আসলাম। “তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ততই ভালো।”
-“আমাদের টার্গেট কপিলমুনি স্কুলঘরটা নিজেদের দখলে নেয়া। তারপর নদীতে করে যে এম্যুনিশন আসবে সেটা ছিনিয়ে নিব।”
-“সেটা কিভাবে?” আনিস জিজ্ঞেস করলো।
-“পাকিস্তানিরা পানি ভয় পায়। ওদেরকে বেকায়দায় ফেলে দেয়া খুব একটা কঠিন কাজ হবেনা।”
আসলাম তাকালো আনিসের দিকে-“এটাই আমাদের অপারেশনের মোটামুটি ব্রিফিং। অপারেশনের আগের দিন আরেকটা ব্রিফিং হবে, এখন টুকিটাকি ব্যাপারগুলো ঠিক করি।” পাশে রাখা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে ম্যাপে মনোযোগ দিলো আসলাম।
এবার কথা বললো রাশেদ। আনিস আর আসলামের কথাবার্তায় তার তন্দ্রার ভাবটা কেটে গিয়েছে অনেক আগেই।
-“আসলাম ভাই, এবার তাহলে একটু ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেন। চিড়া আর পাটালিগুড় খেয়েতো আর চলছেনা।”
-“অপারেশন সফল হলে মাংস-ভাত। এখন একটু ধৈর্য ধর।” হাসিমুখে বলল আসলাম। বিড়বিড় করে কি যেন বলে পাশ ফিরলো রাশেদ, আসলামকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো।
-“ইনফর্মারের উপর কি বিশ্বাস করা যায়?” প্রশ্ন করল আনিস।
-“হুম। আমার তাইতো মনে হলো। মিলিটারির উপর মহাক্ষ্যাপা লোকটা। তার মেয়ের পোষা ছাগলটা ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা।”
হাঁ হয়ে গেল আনিস, ভাবছে- আসলাম ভাইয়ের মাথাটা গেল নাকি। এইটুকুন তথ্য দিয়েই একটা লোককে ইনফর্মার বানিয়ে দেয়া হলো? কত মানুষ আছে, নিজের স্বজন হারিয়েছে, মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি, ভিতরে ক্ষোভ আর শোকের চিতা, তারপরও ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। আর এ কি না...
আনিসের কাধের উপর একটা হাত রাখলো আসলাম।
-“অবান্তর প্রশ্ন করলে আনিস। দেশের জন্য যুদ্ধ করি। দেশের মানুষকে যদি বিশ্বাস না করি তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কি নিয়ে বাঁচবো? এত মানুষের বিশ্বাস আমাদের উপর, তাদের যদি বিশ্বাস না করি তাহলে অনেক বড় অকৃতজ্ঞের মত কাজ হয়ে যাবেনা?”
একটা নিঃশ্বাস ফেললো আনিস। মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিল তার আর কোন সংশয় নেই। এটা এমন একটা সময় যেখানে অনিশ্চয়তায় খুঁজে বেড়াতে হয় নিশ্চয়তার আশ্বাস, শত্রুর দিকে অস্ত্র তাক করে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয় সব কোমলতা। প্রতিশোধের দূর্বার আগুনে পুড়ে একেকজন বুনো হয়ে গেছে। এই একটুখানি বিশ্বাস, আর দেশের জন্য তীব্র একটা ভালোবাসা- এইতো মনের মাঝে সযত্নে পুষে রাখা একটুখানি মানবিকতা। স্টেনগানটা হাতে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল সে।
ছাউনি থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল আনিস। আকাশে মেঘ কেটে গিয়ে অপূর্ব একটা আধখানা চাঁদ বের হয়ে এসেছে। বাতাসে একটা পরিচিত বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধ, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো সে। তারপর ঘাটের দিকে হাঁটা দিলো।
গুনগুন করে গানের সুর ভেসে আসছে বাতাসে। গৌতম গাইছে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো আনিস। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই গৌতমকে দেখা গেলো, একটা গাছে অলস ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে আছে, পাশে রাইফেলটা অবহেলায় ফেলে রাখা। হাতে একটা বিড়ি, টান দিতেই তার আগুনের লাল আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
গৌতমের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে আনিসের। ময়মনসিংহের একটা গ্রাম থেকে তারা ব্রহ্মপুত্রে নৌকা ভাসাতে যাবে, এমন সময় পাগলাটে গোছের লোকটা এসে হাজির। লম্বা লম্বা চুল, গোফ-দাঁড়ির জঙ্গলে ঢাকা মুখ, জ্বলজ্বলে দুটি চোখ আর হাতে একটা দোতারা। আগেই তাকে দেখে এসেছিলো তারা। বাজারে আসর জমিয়ে দোতারায় টুংটাং সুর তুলে গান করছিলো। এসেই বললো- “আমি যুদ্ধে যাবো। আমারে নিয়া যান।” কেউই প্রথমে গা করেনি খুব একটা। কিন্তু নাছোড়বান্দা লোকটা নৌকায় উঠেই ছাড়লো। কি মনে করে আসলাম ভাই আর কিছু বললেন না তাকে। মাঝ নদীতে এসে হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে দোতারাটা পানিতে ফেলে দিলো। তারপর হাতে তুলে নিল রাইফেল।
গৌতমের পাশে গিয়ে বসলো আনিস। দু’জনই চুপচাপ বসে রইলো। আনিস ভাবছে তার মায়ের কথা। অনেকদিন হয়ে গেলো চিঠি লিখা হয়নি। কি লিখবে একগাদা মিথ্যা কথা ছাড়া? মা, আমি ভালো আছি, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছি- এসব লিখে কতদিন আর ধোঁকা দেয়া যায়! দেশের একদল মানুষ প্রাণ বাঁচানোয় ব্যস্ত, কিভাবে পাকিস্তানিদের চোখ এড়িয়ে সীমানা পেরোনো যায় সে চিন্তায় অস্থির, আরেকদল মানুষ তার মত করে দেশ স্বাধীন করার দুর্জয় সংগ্রামে বিভোর, কে তার চিঠি পৌঁছে দিবে মায়ের কাছে? মা বেঁচে আছেন কিনা, সেটাও তো জানা নেই তার।
গৌতমের প্রশ্নে ভাবনায় ছেদ পড়লো আনিসের।
-“ভাই।’
-“বলো।“
-“বাড়ির জন্যে মন কান্দে আপনের?”
-“হুম। মন তো টানেই।” একটুক্ষণ চুপ করে থাকলো আনিস। উত্তরটা যদিও জানা, তারপরও প্রশ্ন করল গৌতমকে- “তোমার মন টানেনা কখনো?”
হেসে ফেললো গৌতম। হাতের রাইফেলটার বাট মাটিতে রেখে খাড়া করল সে।
-“এই বন্দুকের সমান হওনের আগেই ঘর ছাড়ছি। তারপর নায়ে কইরা এই গাও থেইক্যা সেই গাও। এই ঘাট থেইক্যা সেই ঘাট। এই বাজার থেইক্যা সেই বাজার। কিসের জন্য মন টানবো আনিস ভাই?”
-“দেশের জন্যও মন টানেনা তোমার?”
মাথা নাড়লো গৌতম।
রেগে গেলো আনিস। মাঝে মাঝেই গৌতমদার মস্তিষ্কের স্থিরতা নিয়ে সন্দেহ লাগে তার, এখন যেমন লাগছে। একটু উষ্মার সাথেই বললো- “তাহলে আসছো কেন আমাদের সাথে? বাজারে বাজারে গান গেয়েই ঘুরে বেড়াতে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো গৌতম। তারপর জবাব দিলো
-“আমি বাউল মানুষ, গান করতেই আসছি আপনেদের সাথে।”
অবাক হলো আনিস। তাকিয়ে রইলো গৌতমের মুখের দিকে।
-“আগে গাইছি দোতারা দিয়া। এখন গামু এইটা দিয়া।” রাইফেলটা উঁচিয়ে দেখালো সে। হাসলো।
দুজন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আনিসই নিরবতা ভাঙ্গলো।
-“একটা গান শোনাও গৌতমদা।”
ফিসফিস করে গেয়ে উঠলো গৌতম। ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, ঈশ্বর ঘুরেফিরে একইসব ব্যাপার নিয়ে গান। কিন্তু জোছনা আর বৃষ্টিভেজা আঁধার এবং নিরবতা ছিড়ে গৌতমের রহস্যময় কন্ঠস্বর, আনিসের কাছে সবকিছু কেমন অপার্থিব রকমের মায়াময় লাগছে। অদ্ভুত একটা ঘোরে চলে গেলো সে। ঘোরের মাঝেই অপেক্ষা করতে লাগলো হীরণ মাঝির জন্য। অধীর হয়ে কান পেতে রইলো গৌতমদার হাঁকের অপেক্ষায়- “ও মাঝি! কোন ঘাটের মাঝি গো তুমি?” এরপর হীরণের সেই পরিচিত কন্ঠের উত্তর-“রূপগঞ্জ!”
৩।
নিজের ঘরের মেঝেতে বসে আপনমনে শিউলিফুলের মালা গাঁথছে বকুল। ফজরের আযানের একটু আগে তার ঘরের জানালা দিয়ে বের হয়েছিলো সে। তাদের বাড়ির পেছনে গাছ-গাছালির একটা বড় জটলা আছে। বেশ জংলামতন একটা জায়গা, দিনেও একটু একটু অন্ধকার হয়ে থাকে। সেখান থেকে শিউলিগুলো কুড়িয়ে এনেছে সে। গতদিন ঘর থেকে বের হতে পারেনি সে। আজও পারবেনা। বাবার বেঁধে দেয়া তিনদিনের মেয়াদ শেষ হবে আগামীকাল।
শিউলিগুলো লুকিয়ে ফেলা দরকার, ভাবলো সে। বাবা দেখে ফেললে পরে জানালায় বেড়া লাগিয়ে দিবে। তখন লুকিয়েও সবার চোখ এড়িয়ে বের যাওয়া যাবেনা। মালা গাঁথা প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় জানালায় কেউ ঠকঠক করলো। চমকে উঠলো বকুল। কেউ ফিসফিস করে তার নাম ধরে ডাকছে- “বকুল, ও বকুল!”
আস্তে করে জানালা খুললো সে। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা। জাহানারার রাগ পড়ে গেছে এই ভেবে খুশিতে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো বকুল, কিন্তু তার চেহারার দিকে তাকিয়েই দমে গেলো সে। চোখের নিচে কান্নার তরতাজা ছাপ, এলোমেলো হয়ে আছে চুলগুলো। বড় বড় দম নিচ্ছে।
-“কী হয়েছে রে জানা?” উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো বকুল।
-“বাপজানকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।” বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে।
কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলো- “মা’কে না বলে এসেছি। আসতে মানা করছিলো।” হাঁপাতে লাগলো সে-“বাপজান নাকি মুক্তির লোক। কোন দোষ করে নাই সে, ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলো, মিলিটারি এসে ধরে নিয়ে গেছে।”
নিশ্চুপ হয়ে গেছে বকুল। মাথা নিচু করে কাঁদছে জাহানারা। টপটপ করে পানি পড়ছে তার কাদামাখা খালি পায়ের উপর।
-“চাচাজানকে কখন ধরে নিয়ে গেছে?” জিজ্ঞেস করলো বকুল।
-“কাল রাতে। ইস্কুলঘরে নিয়ে গেছে। অনেক পিটিয়েছে নাকি।” চোখ মুছে বকুলের দিকে তাকালো জাহানারা। হঠাৎ বকুলের হাতখানি চেপে ধরলো সে। অবাক হয়ে তাকালো বকুল, জাহানারার চোখে আকুতির ছাপ স্পষ্ট।
-“বকুল, মোসলেম চাচার সাথে তো মিলিটারির উঠবোস আছে। বাপজান মুক্তি করেনা- কসম! চাচাকে একটু বলে দ্যাখ না, বাপজানকে যেন ছেড়ে দেয়। তোর আব্বা বললে ওরা শুনবে। মা কাল থেকে কাঁদছে।” বকুলের হাতটা আরো জোরে চেপে ধরে জাহানারা। “তোর সাথে আর রাগ করে থাকবো না, কসম।” সজোরে ফুঁপিয়ে উঠলো সে।
জাহানারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো বকুল। তার নিজেরও চোখে পানি চলে আসছে।
-“তুই বাড়ি যা জানা। আমি আব্বাজানকে বলে দেখি। কাঁদিসনা আর” জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার চোখটা মুছে দিলো বকুল। মাথা নেড়ে ঘুরে রওনা দিলো জাহানারা। বাড়ির পিছনের জঙ্গলে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত তার দিকে তাকিয়ে রইলো বকুল।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে মাত্র। মোসলেম আলি তার বারান্দায় পেতে রাখা আরামকেদারাতে গা’টা এলিয়ে দিলো। বিনোদবিহারী সাধুর দু’শ বছরের পুরোনো বাড়িকে শান্তি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প করে ফেলেছে তারা। সেখানেই মিলিটারিদের সাথে শান্তি বাহিনীর মিটিং করে মাত্র বাড়ি ফিরেছে সে। জাহানারার বাপকে ধরে নিয়ে এসেছে মিলিটারিরা। নদীর পাড়ে নাকি সারাদিন বসে থাকতো। মোসলেহউদ্দিনের মনে হয়েছে এ বোধহয় মুক্তির লোক। মিলিটারিকে বলতেই তুলে নিয়ে এসেছে তারা। বীভৎস মার খেয়েছে, তাও মুখ খুলেনি। এই ইঁদুরের মত দেহে এত প্রাণ আসে কোথা থেকে ভেবেই অবাক হচ্ছে সে। সারারাত-দিন মার খেয়ে এখন রক্তবমি শুরু করেছে। আজকে রাত টিকবে বলে মনে হয়না। “সব শালা মালাউন” দাঁতে দাঁত চেপে কুৎসিতভাবে গাল দিলো একটা। তামাকের নলটা হাতে তুলে নিলো, হুকোতে এইমাত্র তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে কাজের লোক। এমন সময় মাথা নিচু করে তার সামনে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো বকুল।
-“আব্বাজান।” মৃদুস্বরে ডাকলো সে।
-“কি বলবি?” রুক্ষস্বরে জানতে চাইলো মোসলেম আলি।
-“জাহানারার বাবাকে মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গেছে। আপনি কি একটু ছেড়ে দিতে বলে দেখবেন ওদেরকে? চাচি খুব কান্নাকাটি করছেন।” ভয়ে ভয়ে এক নিঃশ্বাসে কথা বলে ফেললো বকুল।
প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মোসলেম আলি।
-“ওই মালাউনগুলোর জন্য তোর এত দরদ? একেই বলে মেয়েমানুষের মাথা।” মুখে বিশ্রী একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলো।
-“আব্বাজান...” কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো বকুল, কিন্তু বাবার প্রচন্ড ধমকে সারা শরীর কেঁপে উঠলো তার।
-“চোপ! আমার মুখে কথা বলিস তুই? জানিস ওই জাহানারার বাপ কি করে? ওই শালা মুক্তির লোক। ওই হিন্দু মালাউনদের চেয়েও বদ এরা।” খিস্তিখেউড়ের তুবড়ি ছুটিয়ে দিচ্ছে সে।
মাথা নিচু করে রইলো বকুল। বাবার সামনে কাঁদবে না সে। এই অমানুষের সামনে কাঁদাটাও লজ্জার ব্যাপার। কোনমতে চোখের পানি ধরে রেখেছে সে।
-“যা, রসুইঘরে যা। দ্যাখ তোর মায়ের কি কি লাগে, ওর সাথে সাথে থাকবি। মেজর সরফরাজ সাব আজকে খাবেন আমাদের সাথে।” মোসলেম আলি তামাকে একটা লম্বা টান দিলো, গড়গড় করে আওয়াজ বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো সে।
-“বকুল।”
বকুল চলে যাচ্ছিলো। বাবার ডাকে উৎসুক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, ভাবলো জাহানারার বাবা কে নিয়ে কিছু বলবে।
-“মেহমানরা আসলে তুই তোর ঘরে বসে থাকিস মা। আমি বাইরে থেকে শিকল তুলে দিবোনে।” নরম স্বরে বললো মোসলেম আলি। অবাক হয়ে গেলো বকুল।
-“মিলিটারিগুলোর নজর খুব খারাপ। কমবয়সী মেয়ে দেখলেতো এদের আবার মাথা ঠিক থাকেনা।” মেয়ের দিকে তাকিয়ে একবার বোকার মত হাসলো সে। “তুই কিছু মনে নিস না মা। এখন যা, মায়ের কাছে যা।”
একদৌড়ে বারান্দা থেকে নিজের ঘরে পালিয়ে এলো বকুল। মানুষ এমন অমানুষ আর কাপুরুষ কিভাবে হয়? তার বাবার মতো করে? বকুলের মনে পড়লো, অনেক ছোট থাকতে বাবার কাঁধে চড়ে তিন-চার গ্রাম পেরিয়ে মাঘী মেলায় যাওয়ার কথা, বাবার কানি আঙ্গুল ধরে বুকে শ্লেট চেপে ধরে মক্তবে যাওয়ার কথা। বাবা কি আগে থেকেই এমন ছিলেন নাকি এখন এমন হয়ে গেছেন? ভালোবাসার মানুষগুলো অচেনা হয়ে গেলে অসম্ভব কষ্ট লাগে, যেমনটা এখন লাগছে বকুলের।
বকুলের নিজেকে খুব অশূচি মনে হতে লাগলো যখন সে বুঝতে পারলো বারান্দায় বসে থাকা ওই অমানুষটাকে সে আসলেই ভালোবাসে।
৪।
রফিকের ঝাঁকুনিতে আনিসের ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন রোদ প্রায় পড়ে এসেছে। চোখ মুছে উঠে বসলো আনিস। তার দিকে চায়ের একটা মগ এগিয়ে দিলো রফিক। মগের ভেতরে তাকালো আনিস, ভেতরে গাঢ় কালচে রঙের যে তরল দেখা যাচ্ছে সেটাকে চা না বলাই ভালো। গরম পানিতে ইচ্ছামতন লিকার আর গুড় মিশিয়ে এই অদ্ভুত পানীয় তৈরীতে ওস্তাদ রফিক। অন্যদের তৈরি হলে সেটা আর খাওয়ার যোগ্য থাকেনা।
-“রফিক ভাই কখন উঠলেন?” চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো আনিস। জবাব দিলোনা সে। মনোযোগ দিয়ে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও ঝেড়ে মুছে তারপর টিউন করতে লাগলো। কিছু মনে করলোনা আনিস। রফিক বরাবরই কম কথার মানুষ।
রফিকের সাথে আনিসের প্রথম পরিচয় মেঘালয়ে ট্রেনিং নেয়ার সময়। তখন থেকেই একসাথে আছে তারা তিনজন- আসলাম, রফিক এবং আনিস। গ্রেনেড চার্জিংয়ে রফিকের কোন তুলনা নেই, এক থ্রোতে অনেক দূর নিতে পারেন।
একপাশে বসে রাইফেলের নলের সাথে পতাকা বাঁধছে সহযোদ্ধাদের মাঝে সবচেয়ে কম বয়েসি শাহাদত। ক্লাস এইটে পড়তো। পাকিস্তানিরা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে তার বাবার সাথে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। নদীর ধারে সার বেঁধে দাড় করিয়ে যখন রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছিলো তারা, বুদ্ধি করে আগে থেকেই লুটিয়ে পড়েছিলো শাহাদত। এই বুদ্ধিটা বোধহয় খেলেনি তার সহজ-সরল বাবার মাথায়। তাই ব্রাশফায়ারে ছিন্নভিন্ন লাশের মিছিলে মৃত বাবার দেহও চিনে নিতে পারেনি সে। সেদিন বৃষ্টিতে রক্ত আর বারুদ নদীতে ধুয়ে মুছে গেলেও কোনকিছুকেই তার ভেতর থেকে জিঘাংসাটুকু কেড়ে নিতে দেয়নি শাহাদত।
অবশেষে স্টেশন ধরতে পারলো রফিক। ট্রানজিস্টরটা রেখে দিলো টেবিলের উপর। বাজতে লাগলো-“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।” নেশাগ্রস্তের মত কান পেতে রইলো সবাই। কি আশ্চর্য সুন্দর সেই ফুল!
আজ সন্ধ্যায়ই অপারেশন। কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা হয়ে যাবে সবাই। সবার দিকে চাইলো আনিস। একধারে একটা টেবিলে দু’হাতে মাথা চেপে ধরে আছেন আসলাম ভাই, বোধহয় শেষ মূহুর্তের হিসাব কষছেন। নির্লিপ্ত মুখে বিড়ি টেনে যাচ্ছেন গৌতমদা। মন দিয়ে রাইফেলের ব্যারেল পরিষ্কার করছে রাশেদ। রফিক ভাই বসে আছেন চুপচাপ, কি ভাবছেন কে জানে। পতাকা বাঁধা শেষ করে রাইফেলটা কোলে ফেলে একটা বাক্সে হেলান দিয়ে আছে শাহাদত, তার চোখেমুখে হালকা উৎকন্ঠার ছাপ। কল্পনায় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, নৌকার গলুইয়ে বসে হীরণ মাঝি বাতাসের গতি বুঝতে চেষ্টা করছে। সবার মাঝেই অনাগত সময়ের উদ্বেগ ভুলে থাকার একটা সূক্ষ্ণ চেষ্টা।
আগের রাতেই সবাইকে শেষ একটা ব্রিফিং দেয়া হয়েছে। উঠে দাঁড়ালেন আসলাম ভাই। সাথে সাথে বাকি ক’জন। চোখের পলকে একেকজনের চোখের ভাষাই বদলে গেছে। ভয় এবং উদ্বেগকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সেখানে স্থান করে নিলো প্রত্যয়। নিজের অজান্তেই স্টেনগানটা সজোরে আকড়ে ধরলো আনিস। শাহাদতের রাইফেলে বাঁধা পতাকাটা যেন লাল-সবুজ আভা ছড়িয়ে দিলো সবার মাঝে।
ছাউনি থেকে বের হয়ে একেক করে সবাই উঠে বসলো নৌকাতে। লগি ঠেলে ঠেলে নৌকাকে মাঝ নদীতে নিয়ে এলো হীরণ মাঝি। মাথার উপর আগুন ছড়াচ্ছে জুলাই মাসের তপ্ত সূর্য। চুপ হয়ে আছে সবাই। শক্ত করে বুকের সাথে অস্ত্র চেপে রেখেছে। নিরবতা ভাঙ্গলেন আসলাম ভাই।
-“ভয় পাচ্ছিস শাহাদত?” শাহাদতকে প্রশ্ন করলেন তিনি।
-“নাহ্।” অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো সে।
-“রফিক, এক ঢিলে পাইনএপেলকে স্কুলের মাঠ পার করে দিতে পারবিনা? দেখিস, মাঝপথে ফাটেনা যেন।” রফিকের দিকে ঘুরলো আসলাম।
আস্তে করে মাথা নাড়লো রফিক।
-“আনিস মনে আছে? তুমি সিঁড়িগুলো কভার দিবে। হীরণ, তুমি জঙ্গলে নৌকা লুকিয়ে রাখবে। জাহানারার বাবা থাকবেন সেখানে, তোমাকে দেখিয়ে দিবেন কোথায় রাখতে হবে।”
-“জাহানারার বাবা? তার আর কোন নাম জানোনা তুমি?” ভ্রূ কুঁচকে প্রথমবারের মত প্রশ্ন করল রফিক।
মাথা নাড়লো আসলাম। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। এগিয়ে আসছে কপিলমুনি। নিজের অজান্তেই সংকল্পে দৃঢ় হয়ে গেলো আনিসের চোয়াল।
৫।
কানফাটা প্রচন্ড শব্দে আর অনেক মানুষের কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেলো বকুলের। প্রথমে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলোনা কোথায় আছে সে। নিজের ঘর চিনতেই সময় লেগে গেলো অনেক। কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করলো কি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক মানুষ একসাথে চিৎকার করে কাঁদছে, সেই আওয়াজ ছিঁড়ে একটু পর ক্যাট-ক্যাট করে একটা বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়। স্বপ্ন দেখছে নাকি? নাকি কেয়ামত এসে গেলো হঠাৎ করে? ছোটবেলায় মা গল্প শুনাতেন- একদিন নাকি সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সব মানুষ মারা যাবে চোখের পলকেই।
চৌকি থেকে নেমে জানালা খুলেই স্তদ্ধ হয়ে গেলো বকুল। চোখের সামনে পুরো গ্রাম জ্বলছে দাউদাউ করে। জঙ্গলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে জ্বলন্ত ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে, আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে মানুষ। জাহানারাদের ঘর দেখা যায়না তাদের ঘর থেকে, মানিকদের ঘর দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে, জ্বলে ছাই হয়ে গেছে, কংকালটুকু দাঁড়িয়ে আছে কোনমতে। থেকে থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে আসছে। পুরো গ্রামের উপর দিয়ে ধ্বংসলীলা চলে গেছে একটা অথচ তাদের বাড়ি পুরোপুরি অক্ষত। বিদ্যুৎ চমকের মত তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো- এটা কাদের কাজ, কেনই বা তাদের কিছু হয়নি।
দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গেলো সে, কিন্তু ঘরের দরজায় বাইরে থেকে শেকল তুলে দেয়া। রাতের বেলা মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর আর খুলে দেয়নি তার বাবা।
-“আব্বাজান! আব্বাজান! দরজাটা খুলেন আব্বাজান!” পাগলের মত দরজায় কিল দিতে লাগলো বকুল।
-“কি হয়েছে?” রুক্ষ চাপাস্বরে দরজার ওপাশ থেকে জবাব দিলো মোসলেম আলি।
-“দরজাটা খুলেন না আব্বাজান! মানিকদের অনেক বড় বিপদ!”
-“চুপ করে বসে থাক তুই। চিল্লাচিল্লি বন্ধ কর।”
-“মানিক, জানাদের তো কোন দোষ নাই আব্বাজান। ওদের কে থামান না!” হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সে।
-“এরা সব মালাউনের গোষ্ঠী! পাকিস্তান মানেনা একটাও। আল্লার গজব পড়ছে এখন এদের উপর।”
দরজার উপর লুটিয়ে পড়লো বকুল। নিজের অসহায়ত্ব আর একটা অপরাধবোধে দিশেহারা হয়ে গেছে সে।
৬।
অন্ধকারে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আনিস। ঘামে ভিজে গায়ের সাথে এঁটে আছে তার শার্ট। মাথায় একটাই চিন্তা- বাঁচতে হবে, যেভাবেই হোক, যে করেই হোক। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে, স্টেনগানটা উড়ে গিয়ে পড়লো খানিক দূরে। হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। স্টেনগানটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার ছুট লাগালো। এর মাঝেই ভাবতে লাগলো- হিসাবে কি কোন একটা বড় ভুল করেছিলো তারা?
পেছনে সব সহযোদ্ধাকে মৃত ফেলে এসেছে আনিস। একজনও বাঁচতে পারেনি, কাউকে বাঁচাতে পারেনি। আসলাম ভাই, রফিক ভাই, রাশেদ, গৌতমদা, হীরণ মাঝি, শাহাদত...কেউ না। শুরুতেই হোঁচট খেয়ে যায় তাদের অপারেশন, কপিলমুনির জঙ্গলের ঘাটে জাহানারার বাবাকে না পেয়ে। তারপর কপোতাক্ষের বুকে পাকিস্তানি গানবোটগুলোর এলোপাতাড়ি টহল শুরু হয়ে যায় হঠাৎ করেই। তাই ফিরে যাওয়ার কোন উপায় রইলোনা। আক্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু আক্রমণের মিনিট পাঁচেকের মাথায়ই এটা পরিস্কার হয়ে গেলো- মিলিটারিদের হাতে এম্যুনিশন পৌঁছে গেছে। স্কুলঘর থেকে বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে লাগলো তারা। বুলেটগুলো শাঁই শাঁই করে বাতাস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আনিসের পাশে একটু দূরে বসে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিলো রফিক, হঠাৎ ছিটকে পড়ে গেলো সে। বুকে ভর দিয়ে ক্রল করে তার কাছে এগিয়ে গিয়েছিলো আনিস- রফিক নিষ্প্রাণ দুটি চোখ মেলে পড়ে আছে, মাথায় একটা ছোট্ট গোল গর্ত, তা থেকে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তার কিছুক্ষণ পরেই চলে গেল শাহাদত। মেশিনগানের গুলিতে একদম ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল বেচারার বুক। আসলামেরও বুকে গুলি লেগেছিলো। আনিস যখন তাঁর কাছে যায়, তখনও তিনি বেঁচে আছেন, মৃত্যুযন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছিলেন। রক্তে তার জলপাই রঙের শার্ট ভিজে কালো হয়ে গিয়েছিলো, পাশেই পড়ে ছিলো সেলুলয়েডের চশমাটা, ভেঙ্গে একদম চুরমার। রাশেদের কাছে যেতে পারেনি আনিস। দূর থেকে তাকে নিথর পড়ে থাকতে দেখেই বুঝে নিয়েছে যা বুঝার। দৌড়ে নৌকায় ফিরে গিয়েছিলো সে, সেখানেও কেউ নেই। নৌকার চারপাশের পানি রক্তে লাল হয়ে ছিলো, পানির নিচে যে হীরণ মাঝি শুয়ে আছে এটা বুঝতে এক লহমাও লাগেনি আনিসের।
মায়ের কথা মনে হতে লাগলো তার। মা যদি জানতেন, তাঁর ছেলে প্রাণ বাঁচাতে এমন অন্ধকারে জঙ্গলে ছুটে যাচ্ছে, কি করতেন তিনি? ক্যাম্পাসের সেই নাম না জানা মিষ্টি চেহারার মেয়েটার কথাও মনে হতে লাগলো হঠাৎ করে। নিজেই অবাক হয়ে গেল আনিস, কিসব ভাবছে সে? খেয়াল করলো সে, চারপাশে গাছপালা কমে যাচ্ছে। তারমানে জঙ্গল শেষ হয়ে আসছে...তারপর? আর চিন্তা করতে চায়না, মনে হচ্ছে যেন অন্ধের মত ছুটে যাচ্ছে অনন্তকাল ধরে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে, মিলিটারিরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পুরো গ্রামে।
জঙ্গল শেষ হতেই থেমে গেলো আনিস। দিশেহারার মত এদিক-ওদিক তাকালো। একটা আশ্রয় দরকার তার, অন্তত আজ রাতের জন্য। সামনে কালো একটা অবয়ব চোখে পড়লো। একটা বাড়ি, বেড়ার ফাঁক দিয়ে হারিকেনের টিমিটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। দৌড়ে কাছে গেল সে, হাতড়ে হাতড়ে জানালাটা খুঁজে বের করলো। একটানে পাল্লাটা খুলে কোন চিন্তা না করেই ভেতরে ঢুকে গেলো সে। এবং থমকে দাঁড়ালো। ঘরের দরজায় একজন কিশোরী, এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আনিস, ঘুরে ফিরে যাবে নাকি ভাবছে। ঠিক এমন সময় মুখ তুলে তার দিকে তাকালো মেয়েটা, সাথেই সাথেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে যাবে তখনই লাফ দিয়ে এসে তার মুখ চেপে ধরলো আনিস।
-“চুপ করে থাকো!” ফিসফিস করে বললো সে। কিন্তু মেয়েটা মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করতে লাগলো প্রচন্ডভাবে। তার হাতদুটো খামচে ধরলো। একটা মেয়েকে এভাবে ধরে রাখতে আনিসের নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে।
-“চুপ! আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।” গলা আরও খাদে নামিয়ে বললো সে। হাতের বাঁধনে মেয়েটা যেন হঠাৎ করে স্থির হয়ে গেল। আস্তে করে তার মুখ ছেড়ে দিল আনিস।
ছাড়া পেয়েই মেয়েটা ছিটকে দূরে সরে গেলো। সন্ত্রস্তভাবে কাপড় ঠিকঠাক করে নিলো প্রথমেই। ভয়ে কাঁপছে অল্প অল্প। শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।
-“আমি সত্যিই দুঃখিত।” অপরাধীর মত বললো আনিস। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে সে।
-“আপনি মুক্তিযোদ্ধা?” কাঁপুনি থামিয়ে এবার কৌতূহলী বড় বড় চোখ মেলে তাকে দেখতে লাগলো মেয়েটা। তারপর তাকালো হারিকেনের আলোয় চকচক করতে থাকা স্টেনগানের দিকে। মাথা নেড়ে সায় দিলো আনিস। সেও প্রথমবারের মত মেয়েটাকে ভালোভাবে লক্ষ করলো, অন্য দশটা গ্রাম্য কিশোরীর মতই শুকনো, মায়াকাড়া চেহারা।
-“আমি কোন মুক্তিযোদ্ধাকে কখনো সামনাসামনি দেখিনি।”
-“নাম কি তোমার?” জিজ্ঞাসা করলো আনিস।
-“বকুল। আপনি?”
-“আনিস।”
মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে বকুলের। তার ঘরে বসে থাকা এই পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ পেলে তার বাবা কি করবেন? সহজ হিসাব, মিলিটারিদের হাতে তুলে দিবেন যার মানে নিশ্চিত মৃত্যু। সুতরাং বাবাকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবেনা সামনের তরুণের উপস্থিতি। কিন্তু কতক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারবে সেটাও প্রশ্ন।
অনেকক্ষণ পর একটু বিশ্রাম নেয়ার ফুরসত পেলো আনিস। কোমরে বেঁধে রাখা গামছাটা খুলে মুখটা মুছে নিলো একবার। এতক্ষণ উত্তেজনাতে টের পায়নি, এখন বুঝতে পারছে প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে তার। একইসাথে ক্ষুধাও।
-“আপনি কি একা একা এসেছেন? আর কেউ সাথে আসেনি আপনার সাথে?” বকুল জিজ্ঞেস করলো।
-“এসেছিলো। সবাই মারা গেছে।” উত্তর দিল আনিস। চমকে উঠলো বকুল। তারমানে যুদ্ধ একটা হয়ে গেছে তাদের গ্রামে। ওই বিকট আওয়াজগুলো আসলে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন। গ্রামে মিলিটারিদের এই আচমকা হামলার কারণও স্পষ্ট হলো।
-“আমার আজকে রাতের জন্য লুকিয়ে থাকা